পেনাল কোড ধারা ১০৯: অপরাধের প্ররোচনার শাস্তি ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা

পেনাল কোড/দন্ডবিধির ধারা ১০৯: অপরাধের প্ররোচনা

বাংলাদেশ পেনাল কোডের/দন্ডবিধির ধারা ১০৯ অপরাধের প্ররোচনা এবং সেই প্ররোচনার কারণে যদি অপরাধ সংঘটিত হয় তবে তার শাস্তির বিধান প্রদান করে। এখানে যদি প্ররোচনার কারণে অপরাধ সংঘটিত হয় এবং শাস্তির কোন স্পষ্ট বিধান না থাকে, তবে এই ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে। এটি অপরাধ সংঘটনে উস্কানি বা সহায়তা প্রদানকারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ধারা ১০৯ সম্পর্কে বিশদভাবে বোঝা

পেনাল কোডের/ দন্ডবিধির ধারা ১০৯ অপরাধমূলক দায়বদ্ধতার প্রসার ঘটায়, যেখানে প্ররোচনাকারীকে অপরাধ সংঘটিত না করলেও অপরাধের জন্য দায়ী করা হয়। সহজ কথায়, যদি অপরাধ প্ররোচনার ফলশ্রুতিতে ঘটে, তবে প্ররোচনাকারী অপরাধীর মতোই শাস্তি পেতে পারেন।


ধারা ১০৯-এর অধীনে অপরাধের শ্রেণীবিভাগ (কগনাইজেবল/নন-কগনাইজেবল)

ধারা ১০৯-এর অধীনে অপরাধের শ্রেণীবিভাগ নির্ভর করে যে অপরাধটি প্ররোচিত হয়েছে তার প্রকৃতির উপর।

  • কগনাইজেবল অপরাধ: যদি মূল অপরাধটি কগনাইজেবল হয় (যেমন হত্যা, ডাকাতি), তবে ধারা ১০৯-এর অধীনে প্ররোচনাও কগনাইজেবল অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারে এবং তদন্ত শুরু করতে পারে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়াই।
  • নন-কগনাইজেবল অপরাধ: যদি প্ররোচিত অপরাধটি নন-কগনাইজেবল হয় (যেমন মানহানি, সাধারণ আঘাত), তবে ধারা ১০৯-এর অধীনে প্ররোচনাও নন-কগনাইজেবল হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশকে গ্রেপ্তারের জন্য পরোয়ানা এবং ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি প্রয়োজন।

এই পার্থক্য বোঝা জরুরি, কারণ এটি পুলিশ কীভাবে পদক্ষেপ নেবে এবং আসামির বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়াটি কেমন হবে তা প্রভাবিত করে।


ধারা ১০৯-এর ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা সমন

ধারা ১০৯-এর অধীনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা সমন জারি করা হয় প্ররোচিত মূল অপরাধের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।

  • ওয়ারেন্ট মামলা: যদি প্ররোচিত অপরাধটি গুরুতর হয়, যেমন হত্যা বা ডাকাতি (যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দুই বছরেরও বেশি কারাদণ্ড), তবে আসামিকে আদালতে আনার জন্য একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হবে। এটি পুলিশকে আসামিকে বলপ্রয়োগ করে আটক করার ক্ষমতা দেয়।
  • সমন মামলা: কম গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে, যেমন সাধারণ চুরি বা মানহানি (যেখানে শাস্তি দুই বছরের কম), আদালত আসামিকে নির্দিষ্ট তারিখে আদালতে উপস্থিত হওয়ার জন্য একটি সমন জারি করবে।

এই ধরনের ওয়ারেন্ট বা সমনের ভিত্তিতে মামলার পরিচালনা এবং আইনি প্রক্রিয়া প্রভাবিত হতে পারে।


ধারা ১০৯-এর অধীনে জামিনযোগ্য বা অজামিনযোগ্য

ধারা ১০৯-এর অধীনে অপরাধের জামিনযোগ্য বা অজামিনযোগ্য প্রকৃতিও প্ররোচিত অপরাধের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।

  • জামিনযোগ্য অপরাধ: যদি প্ররোচিত অপরাধটি জামিনযোগ্য হয় (যেমন সাধারণ আঘাত, চুরি), তবে ধারা ১০৯-এর অধীনে প্ররোচনা জামিনযোগ্য হবে। এ ক্ষেত্রে, আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিন পেতে পারেন।
  • অজামিনযোগ্য অপরাধ: যদি প্ররোচিত অপরাধটি অজামিনযোগ্য হয় (যেমন হত্যা, অপহরণ), তবে ধারা ১০৯-এর অধীনে প্ররোচনাও অজামিনযোগ্য হবে। অজামিনযোগ্য মামলায়, জামিন প্রদান আদালতের বিবেচনার উপর নির্ভর করে এবং আসামিকে বিচারের আগে পুরো সময় আটক থাকতে হতে পারে।

ধারা ১০৯-এর অধীনে অপরাধটি কম্পাউন্ডেবল বা নন-কম্পাউন্ডেবল

ধারা ১০৯-এর অধীনে অপরাধের কম্পাউন্ডেবল বা নন-কম্পাউন্ডেবল প্রকৃতি অপরাধের উপর নির্ভর করে:

  • কম্পাউন্ডেবল অপরাধ: যদি প্ররোচিত অপরাধটি কম্পাউন্ডেবল হয় (অর্থাৎ ভুক্তভোগী মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন), তবে ধারা ১০৯-এর অধীনে প্ররোচনাও কম্পাউন্ডেবল হবে। যেমন মানহানি, অবৈধ অনুপ্রবেশ ইত্যাদি।
  • নন-কম্পাউন্ডেবল অপরাধ: যদি প্ররোচিত অপরাধটি নন-কম্পাউন্ডেবল হয় (যেমন হত্যা, ধর্ষণ), তবে ধারা ১০৯-এর অধীনে প্ররোচনাও নন-কম্পাউন্ডেবল হবে। এ ধরনের মামলায় মামলা প্রত্যাহার করা যায় না এবং পূর্ণাঙ্গ বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

ধারা ১০৯-এর অধীনে শাস্তি

ধারা ১০৯-এর অধীনে প্ররোচনার শাস্তি মূল অপরাধের সাথে সম্পর্কিত।

  • যদি প্ররোচনার কারণে মূল অপরাধ সংঘটিত হয়, তবে প্ররোচনাকারীকে আসল অপরাধীর মতো একই শাস্তি দেওয়া হবে।
  • যদি প্ররোচনা করা হয় কিন্তু অপরাধ সংঘটিত না হয়, তাহলে প্ররোচনাকারীকে কম শাস্তি দেওয়া হতে পারে, তবে এটি মামলার উপর নির্ভর করে।

এটি নিশ্চিত করে যে যারা অপরাধমূলক কার্যকলাপে উস্কানি বা সহায়তা করেন, তারা শাস্তি পাবেন, এমনকি যদি তারা অপরাধটি সরাসরি না করেন।


ধারা ১০৯-এর অধীনে কোন আদালতে বিচারযোগ্য

ধারা ১০৯-এর অধীনে অপরাধের বিচার যে আদালতে হবে তা প্ররোচিত অপরাধের উপর নির্ভর করে:

  • সেশন কোর্ট: যদি প্ররোচিত অপরাধটি গুরুতর হয়, যেমন হত্যা বা ধর্ষণ, তবে মামলাটি সেশন কোর্টে বিচারযোগ্য হবে। এই আদালতগুলি সাধারণত মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো গুরুতর শাস্তির জন্য নির্ধারিত মামলাগুলি পরিচালনা করে।
  • ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট: কম গুরুতর অপরাধের জন্য, যেমন সাধারণ চুরি বা মানহানি, মামলাটি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে বিচারযোগ্য হবে। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলি সাধারণত তিন বছর বা তার কম শাস্তির মামলাগুলি পরিচালনা করে।

উপসংহার

বাংলাদেশ পেনাল কোডের ধারা ১০৯ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা যা অপরাধ সংঘটনে উস্কানি প্রদানকারী বা প্ররোচনাকারীদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করে। প্ররোচনাকারীর দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা ব্যাপক এবং অপরাধের কগনাইজেবল স্ট্যাটাস, জামিনযোগ্যতা, কম্পাউন্ডেবিলিটি, এবং বিচারিক আদালত সম্পর্কে বোঝা অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে প্ররোচনার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সহায়তা করে।

ধারা ১০৯ এর কার্যকর প্রয়োগ শুধুমাত্র সরাসরি অপরাধীদেরই নয়, যারা নেপথ্যে থেকে অপরাধের সহায়ক ভূমিকা পালন করেন তাদেরকেও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসে।